শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | সময়:
11

মানবিক আদর্শের দীপ্তিতে আলোকিত একটি কল্যাণধর্মী সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল বিশ্বনবী (সা.)-এর নবুওয়তি জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। তিনি গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শৃঙ্খল ভেঙে মানবাধিকারের মুক্তিবার্তা বহন করেন। তিনি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-নির্ধন, প্রভু-ভৃত্য ও আমির-ফকিরের জাত্যাভিমানের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মানবজাতি দেহের মতো এক অখণ্ড সত্তা। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যেমন পৃথক করে দেখা যায় না, তেমনিভাবে সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকেও পরস্পরের তুলনায় খাটো করে দেখা যায় না।

৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরতের অব্যবহিত পর মহানবী (সা.) পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র ও ধর্মমতের জনগোষ্ঠীকে একই বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে আনার জন্য প্রণয়ন করেন ‘মদিনা সনদ’ (The Charter of Madinah)। এটাই ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান। এর আগে শাসকের মুখোচ্চারিত কথাই ছিল রাষ্ট্রীয় আইন। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এটাই ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের শাসননীতি। ইতিহাস প্রমাণ করে এই ঐতিহাসিক সনদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবদমান কলহ ও অন্তর্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সম্প্রীতি, প্রগতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিদায় হজ উপলক্ষে আরাফাত ময়দানে এক লাখ ১৪ হাজার সাহাবার সামনে মহানবী (সা.) যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, তা মানবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সমবেত জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের প্রাণ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সম্মান, তোমাদের এ দিনের মর্যাদার ন্যায়; তোমাদের এ মাসের মর্যাদার ন্যায় এবং তোমাদের এ নগরীর মর্যাদার ন্যায়।’ ‘হে জনগণ! তোমাদের নারীদের ওপর তোমাদের হক রয়েছে এবং তোমাদের ওপরেও রয়েছে তাদের হক। নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে; কেননা তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ আল্লাহর আমানতের মাধ্যমে এবং তাদের লজ্জাস্থান তোমরা হালাল করেছ আল্লাহর কালিমার সাহায্যে। নারীদের সঙ্গে সদাচরণ করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

মোটকথা, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসুলুল্লাহ (সা.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। মদিনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামোয় যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল, পৃথিবীর অন্য কোনো সমাজে তার নজির পাওয়া মুশকিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণে খুলাফায়ে রাশিদিন যে সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন, তা ছিল পুরাপুরি মানবতা ও ন্যায়-ইনসাফনির্ভর। মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের যে নজির ইসলামের মহান রাসুল (সা.) দুনিয়ার বুকে স্থাপন করে গেছেন, তার আলোকশিখা এখনো পৃথিবীতে অনির্বাণ। নবুওয়তি ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মিশন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হাতে পূর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। তিনি সম্যক উপলব্ধি করেন, মানবিক আচরণ ও ন্যায়বিচার এমন এক প্রচলিত নীতি, যার প্রয়োগ সুস্থ সমাজের সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য।

যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। তাঁর উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থা মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে সব দিক দিয়ে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকাশক্তি। জীবনের সব ক্ষেত্রে ইনসানিয়ত ও ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব অপরিহার্য। কারণ মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ছাড়া মানবজীবনের কোনো ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। মানবিক মর্যাদাবোধ ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ এ গুণের কারণেই সৃষ্টি হয়। নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সমাজের অপরাপর সদস্যদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা জরুরি, যাতে কারো প্রতি যেন জুলুম না হয়। মানবতার বিপর্যয়ে বিক্ষুব্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিতে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে বিশ্বনবী (সা.)-এর সুসমন্বিত জীবনাদর্শের অনুশীলন পৃথিবীকে আবাদযোগ্য, সুন্দর ও প্রীতিময় করে গড়ে তুলতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

🆕 নতুন প্রোডাক্ট

  • কোনো নতুন প্রোডাক্ট নেই